আমার জন্ম হয় ১৯৬৩ সালে পুরান ঢাকার চক বাজারের কাছে অবস্থিত মোগলটুলী’র ১৫০ নম্বর বাড়িতে। ১৯৪৭ সালে এই ঠিকানাতেই এক রসিক গাড়োয়ান তার ঘোড়ার গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এসেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেনঃ
“১৫০ মোগলটুলীতে প্রথমে উঠব ঠিক করলাম। শওকত মিয়া মোগলটুলী অফিসের দেখাশোনা করেন। মুসলিম লীগের পুরানা কর্মী। আমারও বন্ধু। শামসুল হক সাহেব ওখানেই থাকেন। …। ঘোড়ার গাড়ি ঠিক করলাম, ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে পৌঁছে দিতে। দেখলাম, রসিক গাড়ওয়ান মোগলটুলী লীগ অফিস চেনে। আমাকে বললো, ‘আপনি লীগ অফিসে যাইবেন, চলেন সাব আমি চিনি’।“ (পৃষ্ঠাঃ ৮৩)
এখানে বঙ্গবন্ধু’র ‘শওকত মিয়া’ হচ্ছেন আমার বাবা শওকত আলী। আমি শওকত আলীর বড় ছেলে। আব্বার কাছে ৪০ এবং ৫০এর দশকের ১৫০ মোগলটুলীর অনেক গল্প শুনেছি। তারই কিছু গল্প আজকে বলব। কিছু গল্প শুনেছি আব্বার কাছে যখন উনি বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের কাছে তার রাজনীতির ইতিহাস বলতেন আর কিছু গল্প বঙ্গবন্ধু’র “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”, “তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরী” এবং বদরুদ্দীন উমরকে দেয়া শওকত আলীর সাক্ষাৎকার থেকে নেয়া।
আওয়ামী লীগ এবং ছাত্র লীগের জন্ম হয় ১৫০ মোগলটুলীতে। এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইতে ছাত্রলীগের জন্মের কথা বলছেনঃ
“১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হল, সেখানে স্থির হল একটা ছাত্র প্রতিষ্ঠান করা হবে যার নাম হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’।…
প্রতিষ্ঠানের অফিস করলাম ১৫০ নম্বর মোগলটুলী। মুসলিম লীগ নেতারা কয়েকবার চেষ্টা করেছেন এই অফিসটা দখল করতে, কিন্তু শওকত মিয়ার জন্য পারেন নাই। আমরা ‘মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ নাম দিয়ে সাইন বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এখন পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিসও করা হল। শওকত মিয়া টেবিল, চেয়ার, আলমারি সকল কিছুই বন্দোবস্ত করল। তাকে না হলে, আমাদের কোন কাজই হত না তখন।“
আব্বা বলতেন ১৫০ মোগলটুলীতে সোহরাওয়ার্দি সাহেব ছাড়া তখনকার প্রগতিশীল বাঙালি রাজনীতিবিদদের প্রায় সবাই এক দিনের জন্য হলেও থেকেছেন। সোহরাওয়ার্দি সাহেব ঢাকায় এলে থাকতেন খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসায় কিংবা ক্যাপ্টেন শাহজাহান সাহেবের বাসা নূরজাহান বিল্ডিং-এ।
আমাদের বাড়িটা ছিল তিনতলা। এক তালায় হায়দার সাহেবের কাগজের দোকান এবং আমরা থাকতাম দোতলা এবং তিনতলা নিয়ে। তিন তালায় তিনটা শোবার ঘর ছিল, তার মধ্যে একটা ছিল বেশ বড়, যার নাম আমরা দিয়েছিলাম ‘বড় ঘর’। এই বড় ঘরই ৪০ এর দশকে আব্বার নিজস্ব রুম ছিল এবং এখানেই বঙ্গবন্ধু থাকতেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেনঃ
“শামসুল হক সাহেব ও শওকত সাহেব আমাকে পেয়ে খুবই খুশি। শওকত আমাকে নিয়ে কি যে করবে ভেবেই পায় না। তার একটা আলাদা রুম ছিল। আমাকে তার রুমেই জায়গা দিল। আমি তাকে শওকত ভাই বলতাম। সে আমাকে মুজিব ভাই বলত।“ (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী,’ পৃষ্ঠাঃ ৮৩)
এই ‘বড় ঘর’ ছিল নেতাকর্মীদের মিটিং, এবং আড্ডার ঘর। খাওয়াদাওয়া এবং মাঝে মাঝে মিটিংও হত দোতলা’র আরেকটি ঘরে। এই বড় ঘরের আরেকটা বৈশিষ্ট হচ্ছে এটার পেছনে দু’টি বড় জানালা ছিল। জানালার পর ছিল একটি খোলা মাঠ, যা ছিল মৌলভি বাজারের শাহ সাহেব বাড়ির মাঠ। এর ফলে এই ঘরে সবসময় প্রচুর আলো বাতাস আসত। গরমের দিনেও এই ঘরটা বেশ ঠান্ডা থাকত। আব্বার কাছে শুনেছি গরমের দিনে অনেক সময় তারা মাটিতেই ঘুমাতেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পুলিশের রেইড থেকে বাঁচতে ১৫০ মোগলটুলির তিন তলার ছাদ থেকে পাশের বাড়ির দোতলার ছাদে লাফ দিয়ে পালানোর কথা। আমার মনে আছে আমাদের বাসার দোতলায় পেছন দিকের একটা জানালা ছিল। ৪০-এর দশকে যখন এটা লীগ অফিস ছিল তখন এই জানালার দু’টো শিক তারা খুলে ফেলেছিলেন। এবং এখান দিয়ে একটা দড়ি ঝুলানো থাকত। পুলিশ এলে এই শিক খোলা জানালা দিয়ে দড়িতে ঝুলে তারা অনেক সময় পালিয়ে যেতেন।
এখান দিয়ে পালানোর একটা গল্প ছোটবেলায় আমরা খুব উপভোগ করতাম। গল্পটা কাউকে বিদ্রূপের উদ্দেশ্যে নয়, যা শুনেছি তাই বলছি।
এক রাতে পুলিশ রেইড দিলে সবাই এই দড়ি বেয়ে নেমে যান। দড়ির শেষ প্রান্তে অবতরণের জায়গায় ঠিকমত ল্যান্ড করাটা একটু কঠিন। একটু এদিক ওদিক হলেই সুয়েরেজে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবণা। সেখানে প্রায় কোমর পর্যন্ত ময়লা পানি। সেই রাত্রে সবাই দড়ি বেয়ে ঠিকমত নামলেও তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে একটু বেগ পেতে হচ্ছিল কারণ তিনি ছিলেন স্থূলকায়।
শেষ পর্যন্ত তিনি নামলেন ঠিকই কিন্তু পড়ে গেলেন ময়লার মধ্যে। পাশের বাড়ির মানুষজন শব্দ পেয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘চোর, চোর।‘ মানিক মিয়া তখন নীচু স্বরে বললেন, ‘আপনারা চুপ করুন। আমি চোর নই।‘ তারপর তাঁকে সবাই মিলে মাঠ পার হয়ে একটা কলের সামনে নিয়ে যান। সেখানে গোসল করে মৌলভি বাজারের ভিতর দিয়ে সবাই পালিয়ে যান।
শওকত আলী ১৯৬৯ সালে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও লেখক/কলামিস্ট বদরুদ্দিন উমরকে একটি ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরলাম।
১৫ ও ১৬ই এপ্রিল ১৯৪৮
“…অবশেষে আমাদেরও (জেল থেকে) মুক্তির আদেশ এলো। তারপর আমাদেরকে ট্রাকে চড়িয়ে ফজলুল হক হলে নিয়ে গিয়ে reception দেওয়া হলো। এর পর আমি এবং মুজিবুর রহমান রাত্রে ১৫০ মোগলটুলীতে ফিরে গেলাম।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেনঃ
“আওয়ামী লীগের প্রথম ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয় ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে। শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক সাহেব তাতে যোগদান করেছিলেন। একটা গঠনতন্ত্র সাব-কমিটি ও একটা কর্মপন্থা সাব-কমিটি করা হল। আমরা কাজ করা শুরু করলাম। শওকত মিয়া বিরাট সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিল। টেবিল, চেয়ার সকল কিছুই বন্দোবস্ত করল। আমি জেল থেকে বের হওয়ার পুর্বে একটা জনসভা আওয়ামী লীগ আরমানিটোলা ময়দানে ডেকেছিল। …(অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠাঃ ১২০, ১২১)
ঢাকা সেন্ট্রাল জেল ছিল ১৫০ মোগলটুলীর খুব কাছে অবস্থিত। রমজান মাসে সেহরি এবং ইফতারের সময় জেলখানা থেকে খুব জোরে সাইরেন বাজানো হত। এই সাইরেন শুনে আমরাও সেহরির জন্য জেগে উঠতাম। আমরা ইফতার করতাম মাটিতে একটি শতরঞ্জি বিছিয়ে। আব্বার কাছে শুনেছি ৩০ বছর আগে এই বাসায় থাকা নেতাকর্মীরা সবাই মিলে মাটিতে এভাবেই ইফতার করতেন। চকবাজারের ইফতারের স্বাদ পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজুউদ্দিন আহমেদ, শামসুল হক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং অলি আহাদ সহ আরো অনেক নেতাকর্মী।
তাজুদ্দীন আহমেদের ডায়েরী থেকেঃ
২ আগস্ট ’৪৭, শনিবার
…ইফতারের সময় শওকত সাহেব ও হায়দার সাহেব এলেন। শওকত সাহেব ইফতারি কিনলেন (সূত্রঃ তাজউদ্দিন আহমেদের ডায়েরী, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৬)।
‘তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি’ থেকে আরও জানা যায় শওকত আলী তাঁর সাথে যৌথভাবে একটা রেশন দোকান করার প্রস্তাব করেছিলেন। পরে রেশনের দোকান দেয়া হয়েছিল কিনা জানা যায়নি।
১৮ অক্টোবর, ’৪৭, শনিবার
“শওকত সাহেব আমাকে যৌথভাবে একটা রেশন দোকান করার প্রস্তাব দিলেন।… সন্ধ্যায় টাইম হলে গিয়ে খানকে পেলাম না। কামরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করে শওকত সাহেবের রেশন দোকান করার প্রস্তাবের কথাটা তাকে জানালাম।“
শওকত আলী ৬০-এর দশকে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু তারপরও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজুদ্দীন আহমদের মত নেতাদের সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখতেন। তিনি আমরণ আওয়ামী লীগের লোক ছিলেন এবং সবসময় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। শওকত আলী ১৯৬১ সালে বিয়ে করেন তারপর সংসার এবং ব্যবসার দিকে মনোনিবেশ করেন।
খন্দকার মুশতাক সম্বন্ধে যতদূর জানি তা হচ্ছে সবাই তাকে একজন চতুর এবং ধূর্ত রাজনীতিক হিশেবে জানতেন। খন্দকার মুশতাক আহমেদ সম্বন্ধে আব্বাকে অনেকবার বলতে শুনেছি, “ওর দাঁতের সমান বুদ্ধিও আমাদের (শেখ মুজিবুর রহমান, তাজুদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ) নাই।“
১৫০ মোগলটুলীর সামনের প্রধান সড়কটি ছিল সে সময়কার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তা। সব ধরণের রাজনৈতিক মিছিল, শোভাযাত্রা, মোহররমের মিছিল এমনকি আর্মির ট্যাঙ্ক এই রাস্তার উপর দিয়েই যেতে দেখেছি। ৭১ সালে দেখেছি পাকি বাহিনীর ট্যাঙ্ক আর দেখেছি ট্রাক ভর্তি লাশ এই রাস্তার উপর দিয়েই নিয়ে যেতে। ৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট আবার দেখেছি আর্মির ট্যাঙ্ক এই রাস্তার উপর দিয়ে যেতে। ৭১’এর যুদ্ধের সময় আমরা কখনও এই বাসায় আবার কখনও পালিয়ে অন্য কোথাও থাকতাম। ২৬শে মার্চ আমরা পালিয়ে জিনজিরা যাই। কিন্তু সেখানে কিছুদিন পরই জিনজিরা গণহত্যা সংঘটিত হয় এবং চারিদিকে গোলাগুলির মধ্যেই আমরা সেখান থেকে পালাই।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণের পর যে শোভাযাত্রা বের হয় তা এই মোগলটুলীর রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। আব্বা তখন ছাদ থেকে তাঁদের দিকে হাত নাড়াচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণের জন্য শোভাযাত্রা থেকে বেরিয়ে আব্বাকে ডেকে নিয়ে যান শোভাযাত্রায় অংশ নিতে। এই স্মৃতিটা আমার এখনও মনে আছে।
বঙ্গবন্ধু এবং শওকত আলী যেসব মুসলিম লীগ গুন্ডাদের কথা উল্লেখ করেছেন তারা স্বাধীনতার পরও সক্রিয় ছিল। আব্বাকে ফোনে বহুবার হুমকি দেয়া হত।
সালাহউদ্দীন আজাদ শওকত
১৫০ মোগলটুলির এই ভবনে ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগের ক্যাম্প অফিস। ঢাকায় এসে সবার আগে এখানেই উঠেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
0 মন্তব্যসমূহ