এটা সত্য যে, ১৯৭১ সালে জাপান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী দেশ ছিল না। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকহানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিজয় লাভের পরও বাংলাদেশকে জাপান দ্রুত স্বীকৃতি দেয়নি।
রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানকারী ২৮তম দেশ জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কের এ পটভূমি সামনে আনলে আপাতদৃষ্টিতে একটু খটকা লাগতেই পারে-তাহলে কি এ দু’দেশের সম্পর্কের কোথাও কোনো ফাঁক আছে?
এ তথ্য স্মরণে রেখেও একাত্তর-পরবর্তী গত ৫১ বছরে ঘটে যাওয়া দেশ দুটির মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সব ঘটনা ও আচরণকে পরিপূর্ণ নিরপেক্ষতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করে বলা যায়, জাপান আজ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে পরীক্ষিত বন্ধু। দূর ও কাছের এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অনেক বড় দেশ বিভিন্ন সময়ে অনেক মিষ্টি-মধুর কথা বললেও তুলনামূলকভাবে অনেক কম কথা বলা দেশ জাপানই বস্তুত ৫১ বছরে বাংলাদেশকে সর্বাধিক আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে।
পদ্মা সেতুসহ বাংলাদেশের এমন কোনো বড় স্থাপনা নেই, যার সঙ্গে জাপানের আর্থিক অথবা কারিগরি সহায়তা যুক্ত হয়নি। তার চেয়েও বড় কথা, অধিকাংশ সাহায্যদাতা দেশই যেখানে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে সাহায্য দিয়ে থাকে, সেখানে জাপানের প্রায় সব সাহায্যই এসেছে নিঃস্বার্থে। তদুপরি বলা দরকার, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের সাহায্যই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের তেমন কোনো উপকারে না এলেও (অধিকাংশই ব্যয় হয়েছে বায়বীয় পরামর্শ, বিদেশ ভ্রমণ ও তাদের নির্দেশিত সরঞ্জামাদি কেনার পেছনে) জাপানের দেওয়া প্রায় প্রতিটি ইয়েনই ব্যয় হয়েছে বাংলাদেশের কোনো না কোনো উৎপাদনশীল খাতে।
অবশ্য কাফকোর (কর্ণফুলী সার কারখানা) মতো দু’একটি স্থাপনা নির্মাণসংক্রান্ত চুক্তিতে গ্যাস সরবরাহ অংশে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা পায়নি, যার জন্য যতটা না জাপান দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী তৎকালীন সামরিক শাসক ও তাদের অনুগ্রহভাজন আমলারা। এ রকম দু’একটি বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম ছাড়া জাপানের অধিকাংশ সাহায্যই বাংলাদেশ ও তার জনগণের উন্নয়নে কাজে লেগেছে। মোট কথা-স্বল্পবচন, মৃদু উচ্চারণ, কার্যকারিতাপূর্ণ আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ ইত্যাদি মিলিয়ে জাপান আজ সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু।
এবার আসা যাক জাপানের সদ্যপ্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রসঙ্গে। সবচেয়ে দীর্ঘ সময়জুড়ে তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন-এটি তার ক্ষেত্রে একটি অভিধা বটে। তবে তাকে মূল্যায়নের জন্য এটিই মূল নির্ণায়ক নয়। বরং অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নতুন করে প্রণীত জাপানের অন্তর্মুখী অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতিকে তিনি আরেক দফা সংস্কারের মাধ্যমে অনেকটাই বিশ্বমুখীন করে তোলেন, যা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কও রয়েছে। কিন্তু তার পরও সত্য হলো, এর মাধ্যমে তিনি জাপানের রাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের বাঁক টেনে দেন এবং সেটাই তার এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী কিনা তা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে।
ইতোমধ্যে আবের ওপর হামলাকারীকে আটক করা হয়েছে এবং পুলিশ সূত্রের খবরে প্রকাশ, হামলাকারী মনে করতেন তার মায়ের ঋণখেলাপি হওয়ার জন্য আবেই দায়ী। তার মা এমন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে অর্থ সহায়তা দিতেন, যাকে সহায়তা দিতেন শিনজো আবেও। এ হত্যাকাণ্ডের কারণ উদঘাটনে এ ক্লুই যথেষ্ট কিনা বা এটিই মূল ক্লু কিনা, তা ভালো বলতে পারবে পুলিশ।
তবে সাধারণ বিশ্ববাসীর কাছে এ এক চরম বিস্ময় যে, জাপানের মতো একটি অহিংস সমাজে এ ধরনের ঘটনা ঘটল কী করে! তাহলে কি সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে নানা মাত্রিক সহিংসতা ক্রমেই জোরদার হয়ে ওঠার ধারা বা ঘটনাবলির সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র রয়েছে? চট করে এর জবাব পাওয়া কঠিন। তবে আবে হত্যা-ঘটনার মধ্য দিয়ে এটি নিশ্চিত হয়ে গেল যে, কোনো দেশ বা সমাজই এখন আর সহিংসতামূলক তৎপরতার বাইরে নেই।
শিনজো আবে প্রথমবার ২০০৬ সালে মাত্র বছরখানেকের চেয়ে কিছু বেশি সময়ের জন্য জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ফলে তার ওই সময়ের নীতি ও কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনার সুযোগ খুব বেশি নেই এবং এটি বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
তবে ২০১২ সালে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) প্রধান হিসাবে দ্বিতীয় মেয়াদে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি যে আমূল পরিবর্তন আনেন, সেটি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। এ সময়ে তার উদ্যোগে প্রবর্তিত ‘বেশি আয়, বেশি ব্যয় ও বেশি কর’ নীতি প্রথমটায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়লেও পরে তা উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারাকে বেগবান করে তুললে সে সমালোচনা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে।
এখানে স্পষ্টীকরণের জন্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উল্লিখিত নীতির আওতায় জাপানে করহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হলে স্বভাবতই তা জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। তবে এটাও ঠিক, এ ধরনের বর্ধিত রাজস্ব আহরণের কারণে জাপানের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সক্ষমতাও বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়, যার আওতায় বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে জাপানি ঋণ, আর্থিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ারও সুযোগ ঘটে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে জাপানি সহায়তাপুষ্ট যেসব প্রকল্প রয়েছে, তার একটি বড় অংশ ওই বর্ধিত কর আহরণ করতে পারারই ফল।
২০১৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফর করেন এবং ওই বছরেরই সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফর করেন জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সদ্যপ্রয়াত শিনজো আবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতা ও মাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের এ সময়কার সহযোগিতামূলক আচরণের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই বাংলাদেশ তার কূটনীতির অতিমাত্রার পশ্চিমমুখী নির্ভরতাকে কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠে প্রথমবারের মতো পূর্বমুখী হওয়ার চিন্তাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। ফলে মানতেই হবে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে একটি প্রকৃত স্বাধীন ভিত্তিদানের ক্ষেত্রে শিনজো আবের একটি পরোক্ষ ভূমিকা ও অবদান রয়েছে।
শিনজো আবের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড শুধু জাপানিদের জন্যই নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্যই গভীর কষ্টদায়ক এক ঘটনা এবং একই সঙ্গে তা চরম ক্ষোভ ও হতাশারও বিষয়। বাংলাদেশের জন্য তা কষ্ট ও ক্ষোভের পাশাপাশি গভীর ক্ষতিরও কারণ। আমরা আশা করব, জাপানিরা তাদের এই মহান নেতার মৃত্যুর কষ্ট সইবার পাশাপাশি তার নির্দেশিত রাষ্ট্রনীতির গণমুখী অংশকে ধারণ করে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে আরও বেগবান করে তুলতে সক্ষম হবেন। বাংলাদেশের মানুষ অবশ্যই গভীর শ্রদ্ধায় ও মমতায় বহুকাল পর্যন্ত তাকে মনে রাখবে এবং সে ধারায় জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আগামী দিনগুলোতে আরও জোরদার হয়ে উঠবে। শিনজো আবের আত্মার শান্তি কামনা করছি।
0 মন্তব্যসমূহ