ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটে যাত্রীবাহী বিলাসবহুল লঞ্চে যাত্রা আর নির্বিঘ্ন থাকছে না। দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে যেতে নৌপথকেই অগ্রাধিকার দেন। আর নৌপথের প্রধান বাহন লঞ্চ থাকে সবার পছন্দের শীর্ষে। সড়ক বা আকাশ পথের চেয়ে কম খরচে যাতায়াত করা যায় লঞ্চে। যাত্রীদের পছন্দের কথা মাথায় রেখে তাই লঞ্চমালিকরা প্রতিযোগিতা দিয়ে বিলাসবহুল লঞ্চ নামাচ্ছেন। এসব লঞ্চে ভিআইপি কেবিনের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণির কেবিন রয়েছে। ডেকেও যাত্রী পরবিহই করা হয়। রয়েছে লিফটসহ নানা সুবিধা।
গত কয়েক বছর ধরে লঞ্চের সংখ্যা বাড়ছে, ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে কয়েকবার; কিন্তু যাত্রীদের সেবার মান সে হারে বাড়েনি। দক্ষ জনবল নিয়োগ না দিয়ে কম টাকায় অদক্ষ জনবল দিয়ে লঞ্চগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে। যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এমনকি মারধরের ঘটনা ঘটছে অহরহ। নানা অনিয়মের বিষয়ে লঞ্চে কোনো যাত্রী প্রতিবাদ করলে তাকে মারধর করা হচ্ছে। এছাড়া লঞ্চে আনসার নিয়োগ করার কথা থাকলেও বেশি বেতনের দোহাই দিয়ে লঞ্চমালিকরা তা নিয়োগ দিচ্ছেন না।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্টরা বারবার তাগিদ দিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার সভায় সংশ্লিষ্টরা লঞ্চে যাত্রীদের নিরাপত্তায় আনসার নিয়োগের বিষয়ে প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু লঞ্চমালিকরা বেশি বেতনের দোহাই দিয়ে তা এড়িয়ে যান।
ঢাকা-বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৪২টি নৌ-রুটে যাতায়াতকারী যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোতে অগ্নিকাণ্ড, হত্যাসহ নানা ঘটনা ঘটছে। কয়েক দিন সংশ্লিষ্টরা নির্বিঘ্ন যাত্রায় নানা প্রতিশ্রুতি দেন। কয়েক দিন পর সব আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
অল্প দিনের ব্যবধানে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড ও সর্বশেষ শনিবার মধ্য রাতে মাঝ নদীতে সুরভী-৯ লঞ্চের সাইলেন্সারে আগুন ও পরবর্তীকালে বরিশাল নদী বন্দরে যাত্রী ও সাংবাদিকদের ওপর লঞ্চের ম্যানেজারসহ স্টাফদের হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সর্বমহল।
ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটে নিয়মিত যাতায়াতকারী একাধিক যাত্রী জানান, কয়েক বছর আগেও প্রত্যেক লঞ্চে আনসার সদস্য নিয়োগ করা হতো। প্রত্যেক লঞ্চে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ জন আনসার সদস্য থাকত। সে সময় কোনো অপ্রীতিকর পরিস্হিতির সৃষ্টি হলে আনসার সদস্যরা তা সামাল দিতেন। কেননা আনসার সদস্যরা মালিকপক্ষসহ তাদের ঊর্ধ্বতনদের জবাবদিহিতার মধ্যে ছিলেন। মালিকপক্ষ অধিক মুনাফার লোভে আনসার সদস্যদের লঞ্চ থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সে জায়গায় নিজস্ব অদক্ষ লোকজন নিয়োগ দিয়েছে। তারা লঞ্চের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় অহরহ ঘটছে অঘটন। সাধারণ যাত্রীরা অহেতুক ইঞ্জিন রুমে ঢুকে পড়ছে। বাধা দেওয়ার মতো কেউ থাকে না। অভিযান-১০ লঞ্চের দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসলেও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা সার্ভে সনদ অনুযায়ী নেই। অধিকাংশ লঞ্চের অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
এছাড়া অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করতে জানেন না লঞ্চের অধিকাংশ স্টাফরা। পূর্বের ন্যায় লঞ্চের ইঞ্জিন রুমের পাশেই চলছে রান্নাবান্নার কার্যক্রম। বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদা বলেন, লঞ্চগুলোতে নিরাপত্তাকর্মী না থাকায় হত্যাসহ নানান অঘটন ঘটলেও মালিকপক্ষ কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। তিনি সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে নৌ-পথে সাধারণ মানুষের যাত্রা নির্বিঘ্ন করার দাবি জানান। এছাড়াও অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসহ অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কার্যকর করারও দাবি জানান। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বিলাসবহুল এসব লঞ্চের মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় পরবর্তীকালে সবকিছু ম্যানেজ করে পূর্বের ন্যায় অদক্ষ জনবল এবং কোনো প্রকার সিকিউরিটির ব্যবস্থা না করেই লঞ্চগুলো পরিচালনা করে থাকেন।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার চেয়ারম্যান মাহবুব উদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম) জানান, লঞ্চগুলোতে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল রয়েছে। এছাড়া যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আনসারদের লঞ্চে নিয়োগ দিলে তারা তাদের থাকার স্থানগুলো পর্যন্ত ভাড়া দিয়ে দেয়। বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম সচিব (সদস্য পরিকল্পনা ও পরিচালন বিভাগ) মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, লঞ্চে নিরাপত্তাকর্মীসহ দক্ষ জনবলের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বার বার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ