নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে রাষ্ট্রপতি যে সংলাপের আয়োজন করেছেন, তা এককথায় অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হক। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনকেন্দ্রিক এবং সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক যে সংকট তা এ সংলাপে সমাধান হবে না। সমাধানের কোনো পথ বা রাস্তাও দেখাবে না। তার মতে, এবারও সংলাপ এবং পরবর্তীতে সার্চ কমিটির মাধ্যমে অকার্যকর, মেরুদণ্ডহীন এবং সরকার অনুগতদের নিয়েই ইসি গঠন হবে। যা দেশের বিদ্যমান সামগ্রিক সংকটকে গভীর থেকে আরও গভীরতর করবে।
সোমবার সাইফুল হক এসব কথা বলেন। এসময় দীর্ঘ আলোচনায় তিনি নতুন ইসি গঠন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, চলমান রাজনৈতিক সংকটসহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন। সাইফুল হক বলেন, আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকলে আইন প্রণয়নসহ রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ কোনো সমস্যা নয়। এখনও হাতে অনেক সময় আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার সেদিকে হাঁটছে না।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি এর আগের দুটি নির্বাচনের সময় এ ধরনের সংলাপ ও সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন করেন। তাতে দেখা গেছে দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশই সরকারের অনুগত। তারা সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। বিদ্যমান সরকার বহাল থাকা অবস্থায় আগামীতে যে ইসি গঠিত হবে তাদের পক্ষে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার কোনো সুযোগ থাকবে না। এ কারণে নির্বাচনকেন্দ্রিক যে গণহতাশা এবং গণঅনাস্থা-তা দূর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এ কারণেই আমরা মনে করি, রাষ্ট্রপতির বর্তমান সংলাপ সময়ের অপচয়মাত্র।
এ থেকে উত্তরণের পথ কি-এমন প্রশ্নের উত্তরে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়কারী এ নেতা বলেন, আমরা সুস্পষ্টভাবে মনে করি যে চলমান সংকটটা রাজনৈতিক। তাই বর্তমান সরকারকেই এ সংকট থেকে উত্তরণে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশবাসীর মতো আমাদের মনেও প্রশ্ন আছে। এরপরও আমরা মনে করি, বিদ্যমান সংকট থেকে উত্তরণে সরকারকেই সব বিরোধী দলের সঙ্গে অর্থবহ ও কার্যকর রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করতে হবে। এ সংলাপ এবং রাজনৈতিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে সংবিধানে উল্লিখিত নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে। এর ভিত্তিতে বিশ্বাসযোগ্য, মেরুদণ্ডসম্পন্ন এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ইসি গঠন করা দরকার। পাশাপাশি বর্তমান সরকার পদত্যাগের পর কিভাবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকি সরকার গঠন করা যায় সে বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা হচ্ছে-দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো অবকাশ নেই। তফশিল ঘোষণার পর নির্বাচন পরিচালনায় ইসির কিছু সুনির্দিষ্ট এখতিয়ার এবং ক্ষমতা থাকলেও বাস্তবে নির্বাহী বিভাগ তথা সরকারের ভূমিকাটাই হয়ে পড়ে নির্ধারক। কারণ সমগ্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ পুরো প্রশাসন সরকারের নির্দেশনাতেই কাজ করে থাকে।
তাহলে কি অতীতের মতোই বাংলাদেশ আরেকটি নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে সাইফুল হক বলেন, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে তেমনই মনে হচ্ছে। সরকার আরও একটি ব্যর্থ নির্বাচনের দিকেই দেশকে ঠেলে দিচ্ছে। তবে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো নতুন কোনো কৌশলে আগামী নির্বাচন আয়োজন করে সরকার পার পেয়ে যাবে-আমি সেই সম্ভাবনাও দেখছি না। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের মানুষ তার ভোটের অধিকারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ব্যক্তিগত মর্যাদা, সম্মান এবং মর্যাদার স্বীকৃতি হিসাবেই দেখে। সেই অধিকারের ধারাবাহিক অস্বীকৃতি কোনোভাবেই তারা মেনে নেবে না।
বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল সংলাপে যায়নি, বিষয়টি কিভাবে দেখছেন-এর উত্তরে তিনি বলেন, যেহেতু একটি দক্ষ, যোগ্য কমিশন গঠন করার বিষয়ে রাষ্ট্রপতির তেমন কিছু করার নেই। এটা উপলব্ধি করেই অনেক রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতির সংলাপকে প্রত্যাখ্যান বা বর্জন করেছে। কারণ শেষ বিচারে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছারই বাস্তবায়ন করতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। তাই এ সংলাপের কোনো অর্থ নেই-এ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেই অনেক রাজনৈতিক দল এবারের সংলাপে অংশ নেয়নি।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে অনেকটা শেষ মুহূর্তে বিএনপি বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। এবার কি করবে তারা, কি মনে হয় আপনার-এমন প্রশ্নের উত্তরে সাইফুল হক বলেন, এটা আসলে বিএনপিই ভালো বলতে পারবে। তবে আমার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বর্তমান চরম কর্তৃত্ববাদী ও দমনমূলক ব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে বিএনপি, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ কোনো গণতান্ত্রিক-দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে না।
এবার আসি স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গে। অধিকাংশ জায়গায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। এটাকে কিভাবে দেখছেন-তিনি বলেন, আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ সংসদ সদস্য একতরফাভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। সেই ধারাটাই আমরা দেখছি স্থানীয় সরকারের এবারের নির্বাচনে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যারা ভোট করছেন-তারা বলছেন, ‘সংসদ সদস্যরা যদি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারেন, তাহলে আমরা কেন পারব না।’ এর পাশাপাশি আরেকটি কারণ হচ্ছে-স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে না বা সরকারি দলের দাপটের কারণে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ভরাডুবি ঘটেছে। এর কারণ কি বলে মনে করেন-উত্তরে সাইফুল হক বলেন, যেসব জায়গায় মানুষ কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারছে সেখানে সরকারদলীয় প্রার্থীর ভরাডুবি ঘটেছে। অনেক জায়গায় তাদের অনেক প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এর রাজনৈতিক তাৎপর্যটাও গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ সুযোগ পেলে সরকারি দলের প্রার্থীকে বর্জন করছে।
বর্তমান সরকারের ৩ বছর পূর্ণ হলো। আপনার বিবেচনায় সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতার দিকগুলো কি কি-উত্তরে তিনি বলেন, গত ৩ বছরে আমাদের সাফল্য হচ্ছে করোনাকালে জাতীয় উৎপাদনে কোনো ধরনের সংকট তৈরি হয়নি। রেমিট্যান্স প্রবাহও অব্যাহত ছিল। এ সময়ে শিল্পোৎপাদন, কৃষি উৎপাদনসহ অনেক খাত বেশ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। আর ব্যর্থতার কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হবে-এ ৩ বছরে সাড়ে তিন থেকে চার কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে গেছে। ১৮ হাজারের বেশি নতুন কোটিপতির জন্ম হয়েছে এ সময়ে। এটা ঠিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চলছে। পাশাপাশি অর্থ পাচার, লুটপাট ও দুর্নীতি সীমাহীন গতিতে বেড়েছে। সুশাসন বলে কিছু নেই দেশে। সর্বত্র আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিরোধী পক্ষ বা ভিন্নমতের ওপর কঠোরভাবে দমন-পীড়ন চলছে। সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে সরকারের ভেতরের এবং বাইরের দুর্র্বৃত্তরা করোনার এ মহামারিকে ব্যবহার করে অবৈধভাবে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে। করোনার দুর্যোগকালে সরকারের একটা সুযোগ ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে তোলা। আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তোলা। একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা। সরকার এ সুযোগটাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। কিংবা কাজে লাগাতে চায়নি। উলটো আরও হিংসা, ঘৃণা, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধাত্মক কৌশল গ্রহণ করেছে। যা দেশকে আজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ