নেতাকর্মীদের বহিষ্কার, পদ থেকে অব্যাহতি ও স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘটনায় টালমাটাল বিএনপি। অনেকটা নিজেদের আগুনে পুড়ছে দলটি। পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে দল থেকে।
এ নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে অসন্তোষ। তাদের অনেকে এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। তবে তারা মনে করছেন, যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তাদের একটা সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।
দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের দল থেকে বাদ দেওয়ায় তৃণমূলে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। এতে আগামী দিনে রাজপথের আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তারা মনে করছেন, দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়নে রয়েছে সমন্বয়হীনতা।
কেউ কেউ এ বহিষ্কার ও অব্যাহতির পেছনে ষড়যন্ত্রও দেখছেন। হাইকমান্ডকে ভুল বুঝিয়ে দলের একটি অংশ এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কাজ করছেন। তবে দলের হাইকমান্ড মনে করছে, দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় এ ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই।
যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করছে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যত বড় নেতা হোন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না-সারা দেশে নেতাকর্মীদের এমন একটা বার্তা দেওয়া হচ্ছে।
বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। কিন্তু তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে তৃণমূলে ছিল অস্পষ্টতা। তারা মনে করেন, দলীয় কোনো নেতাকর্মী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না বলে কেন্দ্র থেকে এমন স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়নি।
নীতিনির্ধারকদের অনেকে বলেছেন, দল কোনো মনোনয়ন দেবে না। তবে কেউ যদি নিজের ইচ্ছায় ভোট করতে চান তাতে বাধাও দেবে না। কেন্দ্রের এমন সিদ্ধান্তের কারণে কয়েক দফা ইউপি নির্বাচনে দলের অনেক নেতাকর্মীই প্রার্থী হন। তাদের অনেকে চেয়ারম্যানও হন।
কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দল কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়নি। এমন পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে অংশ নেন সদ্য বহিষ্কৃৃত অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার। নির্বাচন চলাকালে তাকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ভোটের পর তৈমুরের সঙ্গে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামালকেও করা হয় বহিষ্কার। তাদের দুজনকে বহিষ্কার করা নিয়ে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন।
আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে সরাসরি বহিষ্কার করায় তৃণমূলে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। তারা মনে করেন, কেউ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাজ করলে হাইকমান্ড তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু তাদের তো একটা সুযোগ দিতে হবে।
তৈমুর ও কামালকে বহিষ্কার করায় বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। তারা মনে করেন, তৈমুরের মতো নেতা একদিনে সৃষ্টি হয়নি।
দীর্ঘদিন রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছেন তিনি। হঠাৎ করে এমন একজন পরীক্ষিত নেতাকে বহিষ্কার করা উচিত হয়নি।
আগামী দিনের আন্দোলন সংগ্রামে চাইলেই তৈমুরের মতো একজন নেতার জন্ম হবে না। তাদের অনেকে এ বহিষ্কারের পেছনে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কেন্দ্রের একটি অংশের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করছেন।
তৈমুর আলম খন্দকার যুগান্তরকে বলেন, পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের বহিষ্কারে তৃণমূলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা তা সময় বলে দেবে। আগামী দিনে এ জেলায় কীভাবে আন্দোলন হবে তা একমাত্র আল্লাহ বলতে পারবেন।
তবে আমাকে ও কামালকে বহিষ্কার করায় নারায়ণগঞ্জের নেতাকর্মীরা মর্মাহত। আমি যখন নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতিতে ছিলাম তখন জমজমাট অবস্থা ছিল। এবারের নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী প্যানেলের ভরাডুবি হয়েছে। এ বিষয়গুলো দেখা উচিত।
বহিষ্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দল অনেক সময় ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়। এক্ষেত্রে তাও হতে পারে। আমরা এখন দলের কর্মী না কর্মচারী এটাই বুঝতে পারছি না। কেন্দ্র থেকে আমাকে তো কেউ একটা ফোনও করেনি। ২০১১ সালের মতো যদি বলত; তুমি নির্বাচন থেকে সরে আসো তাহলে অবশ্যই আমি দলের সিদ্ধান্ত মানতাম। কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। এখন বহিষ্কার হলাম।
একই মন্তব্য করেন বহিষ্কৃত নেতা কামালও। তিনি বলেন, আমরা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করেছি, এটা সত্যি। অনেক সময় তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভুল হতে পারে। কিন্তু সেই ভুল শোধরানোর একটা সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। কারণ দীর্ঘদিন আমরা এ দলের পেছনে শ্রম দিয়েছি। বিনিময়ে শেষ সময়ে এসে তার পুরস্কার পেলাম।
কামাল বলেন, আমাকে বহিষ্কার করেছে তা মেনে নিয়েছি। অনেক নেতা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোট করে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দল কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, দল একটা নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। কেউ যদি শৃঙ্খলা না মানে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ কাজ করলে তাকে তো দলের আদর্শিক নেতা বলা যায় না।
তিনি বলেন, কাউকে বহিষ্কার বা অব্যাহতির পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র বা কারও ইন্ধন নেই। তৃণমূল থেকে যে সুপারিশ আসে সেই ভিত্তিতেই দল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কাউকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না, এটা সত্যি নয়।
অনেককে সময় দেওয়া হয়েছে। কাউকে পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, উনি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কাজ করছেন। কিন্তু তারপরও তারা সেখান থেকে ফিরে আসেনি। ফলে চূড়ান্তভাবে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে।
একটি দল তো ফ্রি স্টাইলে চলতে পারে না। এখানে শৃঙ্খলা রাখতেই হবে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যারা যাবেন তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। দলের এমন সিদ্ধান্তে তৃণমূলে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি।
নির্বাচনের পাশাপাশি দল পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। দীর্ঘদিন মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার পর হঠাৎ করেই তাদের সরিয়ে দেওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে এ পরিস্থিতি।
অনেক জায়গায় নেতাকর্মীরা এ নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ। বরিশাল জেলা ও মহানগরের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন মজিবুর রহমান সরোয়ারের আধিপত্য ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
সরোয়ারকে বাদ দেওয়ায় জেলা ও মহানগর নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলছেন না। একই অবস্থা রাজশাহীতেও। মহানগর বিএনপি থেকে হঠাৎ করে সরিয়ে দেওয়া হয় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকেও।
এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ দুই মহানগরের প্রভাবশালী নেতাদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর প্রকাশ্যে কোনো ক্ষোভ দেখা না গেলেও খুলনাতে নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে বাদ দেওয়ায় নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে বিক্ষোভ করেন।
এমনকি মঞ্জু নিজেও কেন্দ্র ঘোষিত কমিটি মেনে নিতে পারেননি। খুলনা জেলা ও মহানগরের কমিটি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। দলের সিদ্ধান্ত না মানায় তাকে শোকজ করা হয়।
সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে শোকজের জবাব দেন তিনি। তবে নিজের ভুল স্বীকার না করে আগের অবস্থানে অটল থাকায় ক্ষুব্ধ হয় হাইকমান্ড।
পরবর্তীতে তাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কেন্দ্রের এমন সিদ্ধান্তের পর খুলনা জেলা ও মহানগর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পাঁচ শতাধিক নেতা একযোগে দল থেকে পদত্যাগ করেন।
নজরুল ইসলাম মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দলকে আরও গুছিয়ে চলা উচিত। স্থানীয় সরকার নির্বাচন ইস্যুতে কেন্দ্রে সিদ্ধান্তে বিভ্রান্তি ছিল। কখনো বলছে আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি না।
আবার বলা হচ্ছে দল করছে না কিন্তু কেউ ব্যক্তিগতভাবে চাইলে করতে পারেন। এমন সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অনেকে নির্বাচন করেছে। কেউ কেউ চেয়ারম্যানও হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নেয়নি।
নারায়ণগঞ্জের ভোটের পর দুজনকে বহিষ্কার করার পরই এটা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। দলের যেমন হাইকমান্ড আছে তেমন তৃণমূলও রয়েছে। তৃণমূলের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং সবাই তা মানে।
0 মন্তব্যসমূহ