১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পলিটিক্যাল অফিসার হিসেবে ভারতীয় উপহাইকমিশন হিসেবে বাংলাদেশে কর্মরত ছিলাম। ১৯৬২ সালের ২৪ মার্চ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বড়দিনের এক নৈশভোজের এক অনুষ্ঠান ছিল। উৎসব শেষে রাত ১২টায় সহধর্মিণীসহ ঢাকায় আমার চক্রবর্তী ভিলায় ফিরলাম। আমার বাড়ির পাশেই ছিল দৈনিক ইত্তেফাক অফিস। ঘরে প্রবেশ করতে না করতেই সামনের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। দরজা খুলে দেখলাম ১৪ বছরের এক ভদ্র, বিনয়ী অচেনা কিশোর দাঁড়িয়ে। সালাম বিনিময় করে সেই কিশোর ছেলেটি আমাকে বললেন, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া আপনাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন।
দৈনিক ইত্তেফাক ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার লেখার আমি নিয়মিত পড়ি। তাই তাকে ঘিরে ছিল আমার আলাদা মুগ্ধতা। তাই ছেলেটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘যাই ঘটুক না কেন আমি এই মধ্য রাতেই দেখা করতে যাব।’ তাই তিনি ছেলেটিকে বলে দিলেন মানিক মিয়াকে গিয়ে জানাও কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি দেখা করতে আসছি।
‘আমি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে মানিক মিয়া তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এই প্রথম আমি তাকে দেখলাম। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে করমর্দন করে অস্বাভাবিক মুহূর্তে দেখা করতে আসায় জন্য ধন্যবাদ জানালেন। তিনি আমাকে নাম ধরে সম্বোধন করলেন এবং পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের দিকে ফিরে তাকিয়ে হাতের ইশারায় পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো ভদ্রলোকরে ছবি আমি পত্রিকায় দেখেছি। তার ভাষণও শুনেছি, তাই চেহারাও খুবই পরিচিত। মানিক মিয়া স্যারকে আমি হেসে বললাম পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।’
তবুও আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর এই প্রথম শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার দেখা। আমাকে বলতেই হবে, এতটা কাছ থেকে তাকে দেখার পর ও তার কথা শোনার পর আমি পুরোটা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
পরিচয়ের সময় মুজিব শক্ত হাতে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন এবং আমাকে তুমি সম্বোধন করে কথা শুরু করলেন। আমি মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে তাকে বললাম, আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন কিন্তু আমি আপনাকে তুমি বলতে পারব না।
সেদিন শেখ মুজিবের পরনে ছিল লুঙ্গি, পায়ে চপ্পল, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, গায়ে সোয়েটার। শেখ মুজিবকে বললাম, আমি অধমের সঙ্গে আপনি কেন দেখা করতে চাইলেন? কেন ডাকলেন? তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, আমি পূর্ববাংলার স্বাধীনতার কথা চিন্তা করছি। শেখ মুজিবের কথা শুনে আমি শুধু চমকেই যাইনি, রীতিমতো দাঁড়িয়ে গেলাম।
অবাক হয়ে বললাম, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা যদি জানে মেরে ফেলবে। এটা তো সাংঘাতিক ব্যাপার। এটা প্রকাশ হবে না তো! প্রকাশ হলে দেশদ্রোহী মামলা হবে। সাবধান, এভাবে ওপেন বলবেন না। আপনাদের প্রাণ তো যাবেই; ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। তবে আপনারা নিশ্চিত থাকুন, আমার তরফ থেকে এটি ফাঁস হবে না। তিনি বললেন, তাদের তরফ থেকেও ফাঁস হবে না। সেদিন এ দুই মহান ব্যক্তির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হলেও তাদের কর্মকা-ের সঙ্গে আমি পেশাগত দায়িত্ববোধের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানসিকভাবে জড়িয়ে গেলাম।
0 মন্তব্যসমূহ