করোনা ভাইরাস দেশে হানা দিয়েছে প্রায় দুই বছর হতে চলল। ফের সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারায় দেশে দৈনিক শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা সাড়ে ছয়শ ছাড়িয়ে গেছে। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে দৈনিক শনাক্তের হার আবার ৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে তিন মাস পর। গত নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর থেকে পুরো বিশ্বেই আবার সংক্রমণ বাড়ছে। ইতিমধ্যে আমেরিকা, ইউরোপ, ও ভারতসহ বিশ্বের অন্তত ১০৬টি দেশে পৌঁছে গেছে ওমিক্রন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সাত জন ওমিক্রনে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, যেহেতু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ওমিক্রন ব্যাপক হারে হানা দিয়েছে, তাই বাংলাদেশ অনেক ঝুঁকিতে আছে। তবে এখন থেকে আগামী দুই মাস মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানলে কম ঝঁুকিতে থাকবে দেশ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব কিছু করা সম্ভব। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করা হলে ভয়াবহ পরিণতি সামনে অপেক্ষা করছে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দেন।
এদিকে করোনা সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করায় স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে ফের কড়াকড়ি আরোপের দিকে যাচ্ছে সরকার। সরকার ওমিক্রন নিয়ে উদ্বিগ্ন, তবে এখনই লকডাউন দেওয়া না হলেও রেস্তোরাঁয় বসে খেতে হলে টিকা সনদ দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি এবং দেশে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী পাওয়ার প্রেক্ষাপটে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের পর এক বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘লকডাউনের বিষয়ে আমরা সুপারিশ করিনি। লকডাউনের পরিস্থিতি এখনো হয়নি। লকডাউনের ঐ পর্যায়ে যাতে যেতে না হয়, সে জন্যই গতকালের এ প্রস্তুতি সভা। যা যা স্টেপ নেওয়ার তা নিব, তারপর দেখা যাক। এখনই লকডাউনের বিষয়ে ভাবছি না। এখন আমরা জোর দেব প্রতিরোধের বিষয়ে।’ জাহিদ মালেক বলেন, ‘মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মাস্ক না পরলে জরিমানা করা হবে। টিকা না নিয়ে থাকলে রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া যাবে না। সেখানে খেতে হলে টিকা সনদ দেখাতে হবে। তবেই রেস্টুরেন্ট তাকে এন্টারটেইন করবে। টিকা সনদ ছাড়া কাউকে খাবার পরিবেশন করলে সেই রেস্তোরাঁকে জরিমানা করা হবে’।
স্কুল খোলা রাখা হবে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের টিকা নেওয়ার ওপর জোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, লক্ষ্য করা গেছে, শিক্ষার্থীরা টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহী নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে কেমন ধরনের কড়াকড়ি আসছে, তা ১৫ দিনের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ থেকে প্রজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে আরো যেসব আলোচনা হয়েছে সেগুলো হলো, স্থল, সমুদ্র ও বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের সংখ্যা বাড়ানো, বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের পুলিশ পাহারায় কোয়ারেন্টাইনে রাখা, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জনসমাগম সীমিত করা, গণপরিবহনে যাত্রী সংখ্যা কমিয়ে আনা এবং মসজিদসহ সব স্থানেই মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন বিশ্বের শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশেও ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশও ঝঁুকিতে আছে। তাই এখন সবার মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। একই সঙ্গে করোনার টিকা নিতে হবে। মিছিল, মিটিং ও সভা-সমাবেশ বন্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘যখন চারদিকে ঝড় হয়, তখন ঘরে না ঢুকলে ঝড়ে মারা যেতে হয়। ঝড় যখন শেষ হবে, তখন বের হতে হবে। যখন জলোচ্ছ্বাস হয়, তখন সাইক্লোন শেলটারে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। ঠিক তেমনি করোনার ভয়ংকর থাবা আসন্ন। তাই এখন থেকে আগামী দুই মাস সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, মাস্ক পরতে হবে। তাহলে আমরা কম ঝুঁকিতে থাকব। এখন জনসমাগম বন্ধ করতে হবে। অর্থনীতি বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। আমাদের প্রস্তুতি আছে। তবে যখন ব্যাপক হারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে, তখন সামাল দেওয়া কঠিন হবে। ’
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, ওমিক্রন নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে সতর্ক থাকতে হবে। সারা বিশ্বে যেভাবে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে বাংলাদেশও ঝঁুকিতে আছে। এখন জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সবাইকে টিকা দিতে হবে। মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। দেশে দৈনিক করোনার পরিস্থিতি গতকাল সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৭৪ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েছে, মৃতু্য হয়েছে চার জনের। এক দিনে এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল সর্বশেষ গত ৬ অক্টোবর। সেদিন ৭০৩ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ার খবর এসেছিল। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৮৭ হাজার ১৪০ জনে। তাদের মধ্যে ২৮ হাজার ৮১ জনের মৃতু্য হয়েছে। রবিবার নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ২ দশমিক ৯১ শতাংশ। গতকাল সোমবার তা বেড়ে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ হয়েছে। এর বেশি শনাক্তের হার সর্বশেষ ছিল গত ২ অক্টোবর। সেদিন প্রতি ১০০ পরীক্ষায় ৩ দশমিক ৪১ জনের কোভিড পজিটিভ এসেছিল। এরপর এত দিন ধরে শনাক্তের হার তিন শতাংশের নিচেই ছিল। এক সময় নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী শনাক্তের হার দুই শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছিল। ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে আবার তা বাড়তে শুরু করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে আরোগ্য লাভ করেছেন ২১৪ জন। তাদের নিয়ে মোট ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭১ জন এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে উঠলেন। কেবল ঢাকা জেলায়ই ৫৬৮ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে গত এক দিনে, যা দিনের মোট শনাক্তের ৮৪ শতাংশের বেশি। দেশের ২৮ জেলায় নতুন কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। গত এক দিনে মারা যাওয়া চার জনের মধ্যে দুই জন ছিলেন ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা; একজন রাজশাহীর এবং একজন খুলনা বিভাগের। গত এক দিনে সারা দেশে মোট ১৯ হাজার ৯৮০টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ ৪৫ হাজার ৮১২টি নমুনা। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মৃতু্যর হার ১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
0 মন্তব্যসমূহ