বরিশালের আসপিয়া ইসলাম কাজলের নাম এখন দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে পরিচিত। কারণ, ভূমিহীন আসপিয়া ‘স্থায়ী ঠিকানা’ না-থাকার অপরাধে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাচ্ছিলেন না। একই অবস্থা খুলনার মিম আক্তারেরও। সরকারি হিসাবই বলছে, দেশে আসপিয়া বা মিমের মতো স্থায়ী ঠিকানাহীন মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৬০ লাখ। বাস্তবে হয়তো আরও বেশি হতে পারে।
স্থায়ী ঠিকানা না-থাকায় মিলবে না সরকারি চাকরিতে নিয়োগ, এমনটাই বলা হচ্ছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। অথচ দেশের আইনে কোথাও বলা হয়নি, স্থায়ী ঠিকানা না-থাকলে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। বরং সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা বিষয়ে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’ তবে সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, সময়ে সময়ে
জারি করা বিধিমালায় এই নিয়মের কথা বলা আছে। এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে প্রার্থীর ১৬ ধরনের তথ্য যাচাই করা হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে প্রার্থীর নাম-ঠিকানা।
অধিকারকর্মীরা বলছেন, অনাথ, অন্যের বাড়িতে আশ্রিত, নদীভাঙনে পড়া মানুষ, বস্তিবাসীসহ অনেকেরই স্থায়ী ঠিকানা নেই। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও শুধু স্থায়ী ঠিকানা না-থাকায় কাউকে নিয়োগ না-দেওয়ার নিয়ম অন্যায্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। সরকারের পুরোনো নিয়ম বদলানো উচিত।
২০১৯ সালের কৃষিশুমারি অনুযায়ী, কোনো ধরনের জমি নেই দেশে—এমন ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা ৪০ লাখ ২৪ হাজার ১৮৯। এর মধ্যে পল্লি এলাকার ২৩ লাখ ২৩ হাজার ২৭০ পরিবার এবং শহরের ১৭ লাখ ৯১৯ পরিবারের নিজস্ব কোনো জমি নেই। একেকটি পরিবারে গড়ে চারজন করে সদস্য ধরলে দেশের ১ কোটি ৬০ লাখ ৯৬ হাজার ৭৫৬ জন মানুষের স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই।
সরকারি চাকরি আইনে বলা আছে, বাংলাদেশের নাগরিক নন এমন কোনো ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ করা যাবে না। প্রজাতন্ত্রের কর্মে সরাসরি নিয়োগের অন্যান্য বিষয় ও শর্তাদি সরকার কর্তৃক, এই আইন ও আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে নির্ধারিত হইবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, আগে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা থাকায় জেলা কোটার প্রার্থীদের নিজ জেলার স্থায়ী ঠিকানায় গিয়ে যাচাই করা হতো। এখন সব শ্রেণির চাকরি থেকেই কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানায় গিয়ে তা যাচাইয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। এরপরও পুলিশ ভেরিফিকেশনে প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানা যাচাই করা হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মনে করেন, কেউ কোনো এলাকায় টানা ছয় মাস ধরে বসবাস করলেই তিনি ওই এলাকার বাসিন্দা হয়ে যান। ফলে আগের জেলা কোটা ধরে প্রার্থীদের স্থায়ী ঠিকানায় গিয়ে তা যাচাই করা অর্থহীন। তিনি বলেন, পুরোনো কালচার পরিবর্তন করা উচিত। কারণ, কোনো আইনে এ ধরনের কিছু নেই। কিছু বিধিমালায় এ বিষয়ে বলা থাকতে পারে। যদি বিধিমালায় এটা বলা থাকে, সেটা পরিবর্তন করা উচিত।
স্থায়ী ঠিকানা না-থাকলে কাউকে সরকারি চাকরি না-দেওয়ার নিয়মকে অন্যায্য বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। গতকাল আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘অনেকেরই স্থায়ী ঠিকানা নেই। অনেকের স্থায়ী ঠিকানা থাকলেও সেখানে আর থাকেন না। কিন্তু সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য যখন সেই ঠিকানা দেয়, সেখানে গিয়ে তাঁকে আর পাওয়া যায় না। অনেক অনাথ অন্যের বাড়িতে মানুষ হচ্ছে, অনেকেই আছেন আশ্রিত, নদীতে অনেকের বাড়ি ভেঙে গেছে, কেউ বস্তিতে বাস করছেন, তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা কী? এঁদের তো স্থায়ী ঠিকানা থাকে না। ফলে নিয়মটি অন্যায্য। নিরাপত্তার খাতিরে যদি স্থায়ী ঠিকানা যাচাই করা হয়, সেটা স্থায়ী ঠিকানা যাচাই না করে আরও অনেকভাবেই করা যায়।’ তিনি বলেন, ‘আসপিয়াকে বাড়ি দেওয়া হচ্ছে, চাকরি দেওয়া হচ্ছে, সেটা ভালো কথা। অধিকারের জায়গায় তো চ্যারিটি আসতে পারে না।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘একজন নাগরিকের চাকরি পাওয়ার অধিকার তাঁর মানবাধিকার। সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও স্থায়ী ঠিকানা নেই বলে চাকরি পাবে না, এটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এটা হতে পারে না। আসপিয়ার ঘটনাটি জানার পর আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। বরিশালের পুলিশ সুপারকে বলেছি, আসপিয়াকে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে। ভবিষ্যতে যাতে কেউ এ ধরনের সমস্যার মুখে না পড়েন, সে জন্য আইন সংশোধন করার জন্য আইজিকে নির্দেশনা দিয়েছি।’
0 মন্তব্যসমূহ