নৌদুর্ঘটনায় দেড় যুগ ধরে ঝুলছে ১৪৬ মামলা

নৌদুর্ঘটনায় দেড় যুগ ধরে ঝুলছে ১৪৬ মামলা

নৌপথে দুর্ঘটনা এবং হতাহতের সংখ্যা-দুই বেড়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না। মামলা হলেও দ্রুত বিচার হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর ধরে ঝুলছে মামলা। গত নয় বছরের মধ্যে ২০২১ সালেই সবচেয়ে বেশি ৩৯টি নৌযান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে সরকারি হিসাবেই মারা গেছেন ১৪০ জন। বেসরকারি হিসাবে সংখ্যা আরও বেশি। এছাড়া নিখোঁজ হয়েছেন অর্ধশতাধিক। এ সময়ে কমেছে নৌদুর্ঘটনার দায়েরকৃত মামলা নিষ্পত্তির হার। দেশের একমাত্র নৌআদালতে গত ১৮ বছরে দুর্ঘটনাজনিত ২৫২টি মামলা হয়েছে।

এ সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০৬টির। এর মধ্যে ৮৮টিতে সাজা হয়েছে এবং ১৮ মামলায় অব্যাহতি পেয়েছেন আসামিরা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানির পর জড়িতরা অল্পতেই পার পেয়ে যান। এর অন্যতম কারণ আইনে কঠোর সাজার বিধান নেই। এছাড়া মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, তদন্ত প্রতিবেদনের ত্রুটিসহ আরও কিছু কারণে পার পেয়ে যান দায়ীরা। এসব কারণে নৌপথ ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি নৌযান নির্মাণে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এ খাতে যারা ব্যবসা করছেন তারা অনেক ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী। তাদের প্রভাবের কারণে গত আট বছর ধরে আটকে আছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ আইন সংশোধন কার্যক্রম। ওই আইনে নৌদুর্ঘটনায় সাজা ১০ বছর প্রস্তাব করা হলেও মালিক ও শ্রমিক নেতাদের চাপে তা কমিয়ে আবার পাঁচ বছর করা হয়। তবে আর্থিক দণ্ডের পরিমাণ বাড়ানো হয়। তবুও এটি এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আইন সংশোধন থেমে নেই। এটি চলছে। ইতোমধ্যে খসড়া আইনটি কেবিনেটে পাঠানো হয়েছে। নৌদুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ফেরি ও লঞ্চ দুর্ঘটনার একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি ও নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে তাদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জানুয়ারি মাসে নৌযান মালিকদের সঙ্গে বসব। এ খাতে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে লঞ্চে আগাম টিকিট কেটে যাত্রীদের উঠতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে সদরঘাটে টিকিট কাউন্টারও তৈরি করেছি।

তবে নৌদুর্ঘটনায় দায়িদের দ্রুত কঠোর সাজা হলে তা কমে আসবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর মূল কারণ হলো নৌযান মালিক-শ্রমিকদের অবহেলা ও বেপরোয়া মনোভাব। এ কারণে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনা বাড়ছে। আরেকটি কারণ হচ্ছে নৌপথে নৌযানের সংখ্যা বেড়েছে। তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় যারা দায়ী তাদেরকে শাস্তি দিলে তা অনেকটা কমে আসবে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নৌদুর্ঘটনায় একমাত্র নৌআদালতে ২০০৪ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ২৫২টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০৬টি। এতে ৮৮টি মামলায় আসামিদের সাজা হয়। ১৮টিতে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মামলা চলমান রয়েছে ১৪৬টি। চলতি বছরে ২৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর আগের বছর ২০২০ সালে মামলা দায়ের হয় ৩০টি। ২০১৯ সালে মামলা দায়ের হয় ২৪টি। গত তিন বছরে মোট মামলার সংখ্যা ৮২টি। এর মধ্যে মাত্র একটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।

মামলা ঝুলে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের সাবেক প্রসিকিউটিং কর্মকর্তা পারভীন সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে দেখেছি, অনেকগুলো কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে সময় বেশি লাগছে। এর বড় কারণ হচ্ছে, মামলার সাক্ষীদের আদালতে সঠিক সময়ে হাজির করা হয় না। অনেক সময়ে সাক্ষীদের কাছে আদালতের সমনও পাঠানো হয় না। এছাড়া নৌদুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তদন্ত কমিটিতে যারা থাকেন তাদের আইন বিষয়ে একাডেমিক পড়াশোনা নেই। ফলে প্রতিবেদনে অনেক ত্রুটি থেকে যায়। এমনও দেখা গেছে, আদালত থেকে ত্রুটির কারণে অনেক প্রতিবেদন ফেরত দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে নৌআদালতের প্রসিকিউটিং কর্মকর্তা বেল্লাল হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, দুর্ঘটনার কিছু মামলা নিষ্পত্তিতে সময় লাগছে সত্য। এখন আমরা অগ্রাধিকারভিত্তিতে মামলা নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা চাই নৌদুর্ঘটনার ন্যায় বিচার হয়। এসব ঘটনায় হতাহতের পরিবার সঠিক বিচার যেন পান। সেজন্য সব প্রক্রিয়া মেনেই এগুচ্ছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাক্ষী হাজির করা চালেঞ্জ। মামলায় সরকারি কর্মকর্তাদের যাদের সাক্ষী করা হয় তাদেরকে পাওয়া যায়। কিন্তু বেসরকারি ব্যক্তিদের হাজির করা কঠিন হয়। এছাড়া নৌদুর্ঘটনা সাধারণত গভীর রাতে বা মাঝনদীতে হয়। এ কারণে প্রত্যক্ষদর্শী কম পাওয়া যায়।

সূত্র - যুগান্তর 

0 মন্তব্যসমূহ

-------- আমাদের সকল পোস্ট বা নিউজ বাংলাদেশের বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা থেকে নেয়া - প্রতিটি পোস্টের ক্রেডিট সেই পোস্টের শেষ ভাগে দেয়া আছে।