রক্ষণাবেক্ষণ দুর্বলতায় বাড়ছে দুর্ঘটনা-মৃত্যু

ছবি - যুগান্তর

রেলওয়ের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কোনো শেষ নেই। অথচ প্রায় চার হাজার কিলোমিটার রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণে তেমন কোনো কার্যকর প্রকল্পই নেওয়া হয় না। আর এ অনীহা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। রেলের দুর্ঘটনার ৮৭ শতাংশই ঘটে বগির (ট্রেন) লাইনচ্যুতির ঘটনায়। এ জন্য দায়ী রেললাইনে পাথরস্বল্পতা।

আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে রেললাইনের নিরাপত্তা তদারকি তলানিতে ঠেকেছে। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও হাতুড়ি-শাবল দিয়ে রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না।

জানা গেছে, চার হাজার কিলোমিটার রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণে সাড়ে ৭ হাজার ওয়েম্যান প্রয়োজন। অথচ রয়েছে ২ হাজার ১০০ জন। আবার অর্ধেক লোকবলই মাস্টার রোলের (অস্থায়ী)। হাতুড়ি-শাবল নিয়ে তারা হেঁটে নামেমাত্র নিরাপত্তা তদারকিতে (লাইন মেরামত) নামেন। ইচ্ছে ও শত চেষ্টা করলেও মান্ধাতা আমলের এমন যন্ত্র দিয়ে রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। ফলে ঊনিশ থেকে বিশ হলেই ট্রেনের (বগি) লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটে। এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থাকে।

রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সারা বিশ্বে ট্যাম্পিং মেশিন অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে রেললাইন সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশে অন্তত ৫০টি ট্যাম্পিং মেশিন এবং পাঁচ শতাধিক হ্যান্ড ট্যাম্পিং প্রয়োজন।

শুক্রবার সরেজমিন রেললাইন ঘুরে দেখা যায়, লাইন ধরে হেঁটে ত্রুটিপূর্ণ স্থান সংস্কার করছেন ওয়েম্যানরা। দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁও ও কাওরান বাজার এলাকায় ওয়েম্যানরা কাজ করছিলেন। প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পর্যবেক্ষণ করা হয়। সেখানে তিনজন থেকে ছয়জনের একেকটি গ্রুপ কাজ করছিল। একেকটি গ্রুপে দুটি থেকে তিনটি শাবল-হাতুড়ি দেখা যায়। এ সময় কারও কারও হাতে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে তৈরি ছাকনাও দেখা যায়।

লাইনের অধিকাংশ স্থানে নেই পর্যাপ্ত পাথর। কোথাও নামেমাত্র পাথর থাকলেও বহু স্থানে নাট-বল্টু-ফিশপ্লেট খোলা দেখা যায়। স্লিপারের নিচে শ্রমিকরা পাথর দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

একইসঙ্গে তারা শুধু হাত দিয়ে নাট-বল্টু, ফিশপ্লেট লাগাচ্ছিলেন। স্লিপারের নিচে পাথর ঢোকার কাজ যথাযথ হচ্ছিল না। রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হয়।

মাঠপর্যায়ে দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ভাই নাম বলব না, আমি কাজ দেখি। উপরের নির্দেশে কাজ করাতে হচ্ছে। একটি স্লিপারের নিচে যথাযথভাবে পাথর ঢোকাতে হলে কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ মিনিট সময় লাগে। সে কাজটিও নামেমাত্র করা হয়। শ্রমিকদের অধিকাংশ মাস্টার রোলের। অভিজ্ঞতাও তেমন নেই।

তিনি আরও বলেন, অন্যসব দেশে এসব কাজে বিশেষ ট্যাম্পিং মেশিন ও সেন্সর ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, আমাদের ভরসা শুধুই হাতুড়ি-শাবল। হেঁটে ট্র্যাক (লাইন) দেখতে হয়।

কয়েকজন শ্রমিক জানান, হাতুড়ি-শাবল দিয়ে বেশিক্ষণ কাজ করা যায় না। তবু মেট (গ্রুপ লিডার) কাজ করিয়ে নেন। কোনো অবস্থাতেই ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে লাইন সংস্কার কিংবা রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। মেট ঘুরেফিরে বেড়ান, বিকাল শেষে চলে যান। উপরে খবর দেন- লাইনে কাজ হয়েছে।

ক্ষোভ প্রকাশ করে এক শ্রমিক বলেন, মাস্টার রোলে কাজ করলেও তারা হালাল করে টাকা রোজগার করতে চান। কিন্তু লাইনে পাথরই নেই। স্লিপারের নিচে-উপরে ও দুপাশে তারা পাথর দেবেন বা কি করে! নাট-বল্টুগুলো বিশেষ মেশিন দ্বারা লাগাতে হয়। অথচ আমরা শুধু হাত অথবা প্লাস দিয়ে নাট-বল্টু লাগাই।

তিনি আরও বলেন, কোনোমতে কাজ হোক তা কর্মকর্তারাই চান। নিয়ম অনুযায়ী- স্লিপারের নিচে চার ইঞ্চি থেকে পাঁচ ইঞ্চি এবং উপরে কমপক্ষে দুই ইঞ্চি পাথর থাকতে হয়। এমন অবস্থা মোট রেলপথের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ স্থানেও চোখে পড়ে না।

রেলওয়ে অবকাঠামো দপ্তর সূত্রে জানা যায়, রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের কোথাও এখন আর ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে হেঁটে লাইন সংস্কার-রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। এটা শুধু বাংলাদেশেই হচ্ছে। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে চারটি এবং পশ্চিমাঞ্চলে দুটি ট্যাম্পিং মেশিন থাকলেও বর্তমানে তিনটি অকেজো।

আবার এসব মেশিন চালানোর মতো দক্ষ অথবা অভিজ্ঞ চালক, মেরামত করার লোক নেই। এগুলো এক মাস চালু থাকলেও দুই মাস ধরে অকেজো পড়ে থাকে। এসব মেশিন মেরামত করার ওয়ার্কশপও নেই। এছাড়া ট্যাম্পিং মেশিন দিয়ে যথাযথভাবে কাজ করতে হলে লাইনে পর্যাপ্ত পাথর থাকতে হয়। পাথর না থাকায় আধুনিক যন্ত্রটি দিয়ে কাক্সিক্ষত কাজও করা সম্ভব হচ্ছে না।

রেলওয়ে প্রকৌশলী দপ্তর সূত্রে জানা যায়, আধুনিক যন্ত্র দিয়ে রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রেলে কোনো দক্ষ জনবল নেই। বছরের পর বছর ধরে যারা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে লাইনে কাজ করেন তাদের কেউ কেউ ট্যাম্পিং ও হ্যান্ড ট্যাম্পিং মেশিনগুলো চালান। লাইন রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বরত ওয়েম্যান বর্তমানে প্রয়োজন প্রায় সাড়ে ৭ হাজার। আছে দুই হাজারের মতো। ওয়েম্যানরা দলবদ্ধভাবে কাজ করেন।

আর সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো- একজন কি-ম্যানের অধীনের পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার রেললাইন থাকে। ম্যানুয়াল পদ্ধতির প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কাঁধে নিয়ে একজন কি-ম্যান লাইন ধরে হাঁটেন। কোথাও কোনো ত্রুটি দেখলে তিনি তাৎক্ষণিক সেটি মেরামত করেন। না পারলে ওয়েম্যানদের খবর দেন। পরে ওয়েম্যানদের দিয়ে মেট ত্রুটি সারানোর চেষ্টা করেন।

একজন কি-ম্যান জানান, কি-ম্যান রোদে পুড়ে লাইনে কাজ করেন। আর মেটরা ট্রলি দিয়ে চলেন। কখনও কখনও কোথাও থামেন। সকালে কিছু সময় থেকে হারিয়ে যান। আবার বিকালের দিকে অল্প সময়ের জন্য আসেন। একজন মেট জানান, লাইনে আমরা থাকলে যে রকম কাজ হয়। আমরা না থাকলেও সেই রকম কাজই হয়।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন কি-ম্যান খালি চোখে লাইনের ত্রুটি কতটুকুই বা দেখতে পারেন। বর্তমান বিশ্বে লাইনের ত্রুটি চিহ্নিত করতে এক ধরনের বিশেষ ট্যাম্পিং ও সেন্সর মেশিন ব্যবহৃত হয়। যা বাংলাদেশে নেই।

লাইনে কর্মরত কি-ম্যান, ওয়েম্যানরাই বললেন, বর্ষা কিংবা শীতকালে লাইনের ত্রুটি একেবারেই চোখে পড়ে না। তারপরও লাইন ধরে তারা হাঁটেন, চোখে পড়লে ত্রুটি সারেন। অধিকাংশ ত্রুটিই চোখের আড়ালে থেকে যায়, ফলে একের পর এক ট্রেন লাইনচ্যুত-দুর্ঘটনা ঘটে। কি-ম্যানরা জানান, তাদের কাজের দায়িত্ব বিশাল বড়। লাইনের জয়েন্ট, নাট-বল্টু, ফিশপ্লেট খুলে বা ঢিলা থাকলে তা লাগিয়ে দিতে হয়। লাইনে পাথর কম থাকলে তা পূরণ করতে হয়। লাইনের ওপর গাছ কিংবা আগাছা জন্মালে পরিষ্কার করতে হয়। কিন্তু, পাথরবিহীন লাইনে পাথর দেওয়া এবং নাট-বল্টু লাগানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আর্কষণ করলেও কাজে আসে না। চাহিদার কথা বলা হলেও বছরের পর বছর পার হয়ে যায়।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে লাইন রক্ষণাবেক্ষণে ডায়নামিক ট্যাম্পিং এক্সপ্রেস মেশিন ব্যবহৃত হয়। এটি দেখতে রেল ইঞ্জিনের মতো-লাইন দিয়ে এটি চললেই অটোমেটিক লাইনের সব ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি, পয়েন্ট ও ক্রসিং সমস্যা সমাধান ও পাথর স্বল্পতার বিষয়গুলো ধরা পড়ে। যা দ্রুত সমাধান করা হয়। বিশ্বে রেললাইন পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। জাপানে ‘স্মার্ট মেইনটেন্যান্স’ পদ্ধতিতে রেললাইন মেরামত করা হয়।

রেলওয়ের সাবেক এক প্রকৌশলী ও মহাপরিচালক জানান, রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণে অত্যাধুনিক মেশিন কিংবা আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করতে চান না ঊর্ধ্বতনরা। কারণ, রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণের নামেই সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয়। পাথর দেওয়া ও সংস্কারের নামে যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয় সেখানে টেন্ডার থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়। লাইন রক্ষণাবেক্ষণ কাজে সম্পৃক্ত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলাসহ রেলপথ মন্ত্রণালয়ে অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে।

সনাতনী পদ্ধতিতে রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণের দুরবস্থার চিত্র এবং সংস্কার কাজে দুর্নীতির বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়। এরপরও যেমন চলার তেমনি চলে। কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না বছরের পর বছর ধরে।

২০১৯ সালে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনাসহ ১০ বছরে অন্তত ২৩টি দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বলছে, লাইন মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণের অভাবই দুর্ঘটনার মূল কারণ। এসব দুর্ঘটনায় দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে সুপারিশ করা হলেও ‘সাময়িক বরখাস্ত’ করেই দায় সারেন সংশ্লিষ্টরা।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে প্রধান প্রকৌশলী সুবক্তগীন জানান, রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণে সবেচেয় গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিক হলেন- ওয়েম্যান, কি-ম্যান ও মেট। এ তিন পদেই লোকবল স্বল্পতা রয়েছে। নতুন নিয়োগ হচ্ছে-আশা করি সমস্যা থাকবে না। তবে আধুনিক প্রযুক্তির দিকে যেতে হবে। ম্যানুয়ালে লাইন যথাযথ রাখা সম্ভব হয় না। সাড়ে ৪ হাজার লোকবলের স্থলে রয়েছে মাত্র দুই হাজার ১০০ জন। সনাতনী পদ্ধতিতে কাজ করারও লোকবল নেই। সর্বোচ্চ কাজ করছি।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (রেলপথ) আসরাদুল হক জানান, দুটি ট্যাম্পিং মেশিন ছিল। একটি নষ্ট। ম্যানুয়াল পদ্ধতিই বেশি আর্শীবাদ। এ অঞ্চলেও লোকবল স্বল্পতা রয়েছে। ১ হাজার ওয়েম্যান আছে। কিন্তু প্রয়োজন সাড়ে ৩ হাজার।

রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) কামরুল আহসান জানান, আমরা আরও ১৫টি ট্যাম্পিং ও শতাধিক হ্যান্ড ট্যাম্পিং মেশিন কিনেছি। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অত্যাধুনিক ট্যাম্পিং সেন্সর মেশিনও কেনা হবে।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক জানান, বাংলাদেশের ট্রেন শুধু নাচানাচি করে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ট্রেন এমন করে নাচানাচি করে না। রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণে কারও নজর নেই। নজর শুধু নতুন প্রকল্প গ্রহণে। নতুন প্রকল্প গ্রহণেও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই। রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণেও চরম দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সনাতনী পদ্ধতিতে রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। এতে দুর্ঘটনা যেমন বাড়ছে প্রাণও ঝরছে। নতুন অথবা পুরাতন রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা না হলে সেবার সঙ্গে নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়বে। দিন দিন রেললাইন ভয়ংকর হয়ে উঠবে। নতুন প্রকল্পেও সুফল মিলবে না।

0 মন্তব্যসমূহ

-------- আমাদের সকল পোস্ট বা নিউজ বাংলাদেশের বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা থেকে নেয়া - প্রতিটি পোস্টের ক্রেডিট সেই পোস্টের শেষ ভাগে দেয়া আছে।