ঘড়ির কাঁটায় বেলা ১১টা ৭ মিনিট। এইচডিইউ ওয়ার্ডে টানা আর্তনাদ-‘আমার মা কই, আমার বোন কই, আমারে ছাইড়া দ্যাও, আম্মারে-বোইনরে আইন্যা দ্যাও...।’ যন্ত্রণাকাতর ১১ বছর বয়সি লামিয়া আক্তারের এমন আকুতিতে চিকিৎসক, নার্স, রোগী ও স্বজনরা স্তব্ধ হয়ে যান। লামিয়ার কান্না শেষ হচ্ছিল না। বেড থেকে চিৎকার করে বলছিল, ‘দাদু, অ-দাদু তুমি আমারে ফালাইয়া যাইও না, আমারে লইয়া যাও...।’
শিশু লামিয়া আর দাদি মমতাজ বেগম (৭৭) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) ভর্তি ছিলেন। বেলা ১১টা ২৭ মিনিটে ট্রলিতে লামিয়ার বেডের পাশ দিয়ে দাদিকে আইসিইউতে নেয়া হচ্ছিল। ওই সময় তাকে দেখে লামিয়া চিৎকার শুরু করে। পরিস্থিতি সামলাতে নার্স-চিকিৎসকরা দাদিকে দ্রুত বের করে নেন।
অভিযান-১০ লঞ্চে ঢাকা থেকে মা-বাবা, ছোট বোন আর দাদির সঙ্গে বৃহস্পতিবার বরগুনায় যাচ্ছিল লামিয়া। মা রাজিয়া বেগম আর ছোট্ট বোন নুসরাত (৬) এখনও নিখোঁজ। বাবা ইসমাইল বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসক বলছেন, লামিয়া ও মমতাজ বেগম শঙ্কামুক্ত নয়। লামিয়াকে কৃত্রিম শ্বাস দেয়া হচ্ছে। খাবার দেওয়া হচ্ছে নাক দিয়ে। বেডের পাশেই বসে কাঁদছিলেন খালা হাসি আক্তার। তিনি বললেন, বড় বোন রাজিয়ার ৪ মেয়ের দুজনের বিয়ে হয়েছে। দুলাভাই ঢাকার বাড্ডায় থাকেন। দেড় মাস আগে দুই মেয়ে লামিয়া, নুসরাত ও শাশুড়িকে নিয়ে ঢাকায় আসেন বোন। ঢাকায় দুই মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করা হয়।
দাদি মমতাজের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বারবারই ছেলে, ছেলের স্ত্রী আর দুই নাতনির কথা বলছিলেন। জানালেন, মধ্যরাতে আগুন আগুন চিৎকারে তাদের ঘুম ভাঙে। জীবন বাঁচাতে ছেলে তাদের আঁকড়ে ধরেন। ওই সময় চারপাশ অন্ধকার হয়ে ওঠে। ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মানুষের ধাক্কায় একে অপরের হাত ছুটে যায়। শুধু চিৎকার। এক সময় তিনি পানিতে পড়ে যান। তারপর আর কিছুই বলতে পারেননি তিনি।
লামিয়ার নাকে-মুখে নল আর অক্সিজেন মাস্ক। পাশে দাঁড়িয়ে শোনা গেল শুধু কান্নার শব্দ। মা-বাবা, বোন আর দাদিকে দেখার আকুতি। নার্স বারবার অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিচ্ছিলেন। চিকিৎসক জানালেন, লামিয়া ভালো নেই। কিছুক্ষণ পর পর চিৎকার দিয়ে ওঠে। মাস্ক-নল খুলে ফেলতে চায়।
হাসি আক্তার ধরা গলায় বললেন, লামিয়াকে আমাদের মিথ্যা বলতে হচ্ছে। বলছি, মা-বাবা-বোন বরিশালের বাড়িতে আছে। আর কত মিথ্যা বলব!
দিন দিন স্বজনদের সংখ্যা বাড়ছে বার্ন ইউনিটের বারান্দায়। আইসিইউ, এইচডিইউতে খুব প্রয়োজন ছাড়া তাদের ঢুকতে দেয়া হয় না। বারান্দায় তারা চিকিৎসক নার্সদের কাছে আর্জি করেন, তাদের প্রিয় মানুষগুলোকে যেন সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেয়া হয়।
এদিকে, রোববার মনিকা রানী হাওলাদারকে (৪০) এইচডিইউ থেকে আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সেখানে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন মারুফা বেগম (৪৮) ও শাহিনুর খাতুন (৪৫)। মনিকা রানীর ছোট বোন কনিকা রানী জানান, লঞ্চে দিদির সঙ্গে স্বামী ও ছেলে গুরুতর আহত হয়। এখন দিদির অবস্থা খুবই খারাপ। সুস্থ হবে কিনা, ডাক্তার নিশ্চিত করে কিছুই বলছেন না।
এদিকে, এএইচডিইউতে থাকা ছোট্ট তামিম হোসেন (৫) যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। মা জেসমিন লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে। ইতোমধ্যে জেসমিন তার মেয়ে মাহিদা (১৫) ও গর্ভে থাকা ৬ মাসের মেয়েকে হারিয়েছেন। শুক্রবার ঢাকায় আনার পথে মৃত্যু হয় মাহিদার। আর শনিবার জেসমিনকে অপারেশন করে মৃত সন্তান বের করা হয়।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, লঞ্চে আগুনের শিকার ২১ জনকে ইনস্টিটিউটে আনা হয়েছিল। ৫ জনকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। রোববার পর্যন্ত ১৫ জন ভর্তি রয়েছে। একজন মারা গেছে। বর্তমানে ৩ জন লাইফ সাপোর্টে আছেন। বাকিদের কেউ শঙ্কামুক্ত নয়। তিনি বলেন, বরিশালে বার্ন ইউনিটে একটি চিকিৎসক দল দগ্ধ ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিচ্ছে। তাছাড়া এ ইনস্টিটিউট থেকে সার্বক্ষণিক টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ