কৃষকদের অর্থায়নকারী প্রধান প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক বা বিকেবি। বিভিন্ন সময়ে সরকার এ ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষিঋণ ও সুদ মওকুফ করায় কৃষক স্বস্তি পেলেও ব্যাংকটি স্বস্তিতে নেই। একদিকে বিপুল অঙ্কের মূলধন ঘাটতি তৈরি হয়েছে, ফলে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না।
অন্যদিকে বাণিজ্যিক মুনাফার চেয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে ব্যাংকটি বাজারভিত্তিক আয়ও করতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ, বিভিন্ন সময়ে সরকার কৃষিঋণ ও সুদ মওকুফ করলেও ব্যাংকে তার ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ করেনি। এ রকম আরও কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভার টানতে গিয়ে ধুঁকছে ব্যাংকটি।
কৃষি ব্যাংকের দীর্ঘদিনের কার্যক্রম বিশ্নেষণে এমন চিত্র উঠে এসেছে। ১৯৮৬ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কয়েকটি সরকার জনগণের কাছে জনপ্রিয় হতে গিয়ে ব্যাংকটিকে ভঙ্গুর অবস্থায় ফেলেছে। সর্বশেষ হিসেবে এর মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১১ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। দায়িত্বশীল কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকটি গত সেপ্টেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে পুনঃমূলধনীকরণ সহায়তা চেয়েছে।
তবে নগদ টাকা চায়নি। চেয়েছে ১০ বছর মেয়াদি জিরো কুপন বন্ড। এটি ৪ শতাংশ সুদের বন্ড। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে এ আবেদন করেছে কৃষি ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আবেদনটি বিবেচনার জন্য অর্থ বিভাগে পাঠিয়েছে। অর্থ বিভাগ এখনও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানায়নি।
কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শিরীন আখতার ওই আবেদনে বলেছেন, বর্তমান যে মূলধন ঘাটতি তার অন্যতম কারণ দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত লোকসান। এ ছাড়া বাজারভিত্তিক সুদহার বিবেচনা না করে ধারাবাহিকভাবে হ্রাসকৃত সুদহারে ঋণ বিতরণও ব্যাংকের দুর্বল পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে তহবিল ব্যয়ের চেয়ে কম সুদে ঋণ বিতরণ করে ব্যাংকটি। এজন্য প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে লোকসান দিতে হয়।
আবেদনে আরও বলা হয়, কৃষি ব্যাংক তুলনামূলক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ খাতে অর্থায়ন করে থাকে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে এ কর্মকৌশল সরকারই নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ দেশে শস্যঋণ অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এ ব্যাংকের ঋণ পোর্টফলিওর ৮৫ ভাগই কৃষিঋণ। প্রায়ই বন্যা, খরা, নদীভাঙনসহ বিভিন্ন কারণে ফসলহানি ঘটে। বাজারজাতকরণও ব্যাহত হয়। এতে উৎপাদকরা যেমন ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না, তেমনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রুগ্ণ হয়ে পড়ে।
গতকাল সোমবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিরীন আখতার সমকালকে বলেন, মূলধন ঘাটতি পূরণে বন্ড ইস্যুর জন্য যে আবেদন করা হয়েছে, এখনও তার অনুমোদন পাওয়া যায়নি।
কৃষি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মো. নাসিরুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মতামত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
তবে শুধু ভর্তুকির ঘাটতি এবং কম সুদে ঋণ বিতরণের কারণেই কৃষি ব্যাংক সমস্যায় পড়েছে, তা মানতে চান না আর্থিক খাতের বিশ্নেষকরা। তারা বলছেন, ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায়ও নানা দুর্বলতা ছিল।
এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে ভালো গ্রাহক নির্বাচন, প্রকৃত কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ এবং কার্যকর ঋণপণ্য তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
কৃষি ব্যাংকের এ পরিস্থিতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, কৃষি ব্যাংকের ভঙ্গুর পরিস্থিতি পুরোনো। বাংলাদেশ ব্যাংকও কয়েকবার মূলধন সহায়তা দিয়েছে।
তিনি বলেন, ভর্তুকি না পাওয়া বা কম সুদে ঋণ দেওয়া কৃষি ব্যাংকের নাজুক পরিস্থিতির একটি কারণ। তবে এটি সামগ্রিক দুর্বলতার একমাত্র কারণ নয়। কৃষির নামে অনেক বড় ঋণ দেওয়া হয়েছে, যেগুলো পরে খেলাপি হয়ে গেছে। যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত গ্রাহককে ঋণ দেওয়া হয়নি। আবার কৃষকের ঋণে মধ্যস্বত্বভোগী ঢুকে পড়েছে। এসব কারণেই ব্যাংকটি সংকটে পড়েছে।
কৃষি ব্যাংকের একজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মূলধন ঘাটতির প্রধান কারণ হচ্ছে কস্ট অব ফান্ড বা তহবিল ব্যয়ের তুলনায় কম সুদে ঋণ বিতরণ। সরকার কম সুদে কৃষি ঋণ বিতরণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে কৃষি ব্যাংক কম সুদে ঋণ বিতরণ করে আসছে। এ কারণে লোকসান হচ্ছে। দীর্ঘদিনের লোকসানের কারণে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সরকারি সিদ্ধান্তে মওকুফ করা ঋণ ও সুদের পুনর্ভরণ সময়মতো না পাওয়ার কারণে ব্যাংকটি মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।
যেসব রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জের টানতে হচ্ছে :১৯৮২ সালে ব্যাংকটিতে প্রথম বড় ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। তৎকালীন সরকার অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মন্দ ঋণের ভারে জর্জরিত ও লোকসানি শাখা চাপিয়ে দেয় কৃষি ব্যাংকের ঘাড়ে। ওই বছর সরকারি সিদ্ধান্তে রূপালী, পূবালী ও উত্তরা ব্যাংকের ১৪৮টি লোকসানি শাখা বিপুল পরিমাণ কু-ঋণ ও জনবলসহ কৃষি ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে কৃষি ব্যাংকের নন-পারফর্মিং ঋণ অনেক বেড়ে যায়।
এর পর ১৯৯৪-৯৫ সালে রূপালী ব্যাংকের কু ও মন্দ ঋণের ভারে জর্জরিত ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ কর্মসূচির (এসইসিপি) ৩২৬টি ইউনিট কৃষি ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এ ছাড়া ১৯৮৬ সালে সরকারি সিদ্ধান্তে ১৩১ কোটি এবং ১৯৯১ সালে ৮৩৭ কোটি টাকা অর্থাৎ মোট ৯৬৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে কৃষি ব্যাংক। সুদ মওকুফ বাবদ সরকার কয়েক বছর পর ব্যাংকটিকে দেয় ৩৯৫ কোটি টাকা।
বাকি ৫৭৩ কোটি টাকা এখনও সরকার দেয়নি। তিন দশকের বেশি সময় আগের এই বড় ঘাটতিই ব্যাংকটিকে দুর্বল করে দেয়। এ ছাড়া ১৯৯৩ সালে তৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত দেয়, তিন লাখ টাকা পর্যন্ত মূল কৃষিঋণ সুদাসলে দ্বিগুণ হওয়ার পর সুদারোপ করা যাবে না। ওই সময় এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলারও জারি করে। এ সিদ্ধান্তের ফলে কৃষি ব্যাংকে মন্দ ঋণ বেড়েছে। ২০০৪ সালে বন্যার পর সরকার পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণের সুদ দায়মুক্ত ঘোষণা করে।
এতে ব্যাংকের ১১০ কোটি টাকা মওকুফ করতে হয়েছে। এর মধ্যে ৪৪ কোটি টাকা সরকার ভর্তুকি হিসেবে দিয়েছে। বাকি ৬৬ কোটি টাকা ব্যাংকের লোকসান। এভাবে ব্যাংকটির ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ দিনকে দিন বেড়েছে। সর্বশেষ হিসাবে ব্যাংকটির মোট ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা।
অন্যান্য কারণ : ২০১০ সালে হঠাৎ করেই ব্যাংকটি শিল্প খাতে বড় ঋণ বিতরণ শুরু করে। পোশাক শিল্প, কোল্ডস্টোরেজসহ আরও কিছু বড় শিল্পে ঋণ দেয়। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হঠাৎ অনেক বেড়ে যায়। বর্তমানে যে খেলাপি ঋণ রয়েছে তার বেশিরভাগই শিল্প খাতে। আবার ব্যাংকটির তহবিল ব্যয়ও বেশি। গত জুনের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকটির কস্ট অব ফান্ড বা তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষিঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৮ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে। কৃষি ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রে ৮ শতাংশের কমেও ঋণ বিতরণ করছে। ফলে ব্যাংকের লোকসান অবধারিতভাবেই হচ্ছে।
সর্বশেষ আর্থিক চিত্র :বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে কৃষি ব্যাংকের ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দুই হাজার ৪০৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে ঘাটতি রয়েছে ২১ কোটি টাকা। সারাদেশে শাখা রয়েছে এক হাজার ৩৮টি।
সূত্র -
0 মন্তব্যসমূহ